Skip to main content
philosophy

মৃত্যুদণ্ড ও নৈতিকতা

7 min read
মৃত্যুদণ্ড ও নৈতিকতা

মানব সভ্যতার শুরু থেকেই সব সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান জারি ছিল এবং এখনও আছে। অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিচার এবং তার নৈতিকতা মাপা আমার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না, ইতিহাসের ঘটনাকে কেবল ইতিহাস হিসাবেই পাঠ করতে হবে। বরং আমাদের সময়কে আমাদের দৃষ্টিকোণে নৈতিকতার নিক্তিতে মাপা কর্তব্য। ফলত মৃত্যুদণ্ডের বিধানের নৈতিকতার পুনর্নির্ণয়ণ জরুরি।

একেবারে গোড়াতে আগে দৃষ্টি দেয়া দরকার যে বিচারের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন কী? কোন অন্যায় ঘটলে কেন আমরা ঘটা করে, সময় খরচ করে বিচারের আয়োজন করি? অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও তো খুন হয়, ধর্ষণ হয়— তারা তো এমন বিচারের আয়োজন করে না। আমরা কেন করি? এটা ভাবা দরকার। আমার মনে হয় বিচার আয়োজনের একেবারে মৌলিক উদ্দেশ্য হলো— ১। ন্যায় ও অন্যায় চিহ্নিত করা ২। অন্যায় সংঘটনের ফলে যে অসাম্যর সৃষ্টি হয় তা প্রশমণের ব্যবস্থা করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা (অর্থাৎ ভিকটিমের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা) ৩। অন্যায়কারী যাতে ভবিষ্যতে তদ্রুপ অন্যায় আর না করে এবং না করতে পারে তা নিশ্চিতকরণ (অর্থাৎ অন্যায়কারীকে প্রয়োজনীয় সংশোধন প্রক্রিয়ার মধ্যে নেওয়া এবং যে অনুকুল পরিবেশে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল তার মেরামত)।

আমাদের প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হবে যে প্রত্যেক জীবের বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এই অধিকার জীবের সর্বোচ্চ এবং সার্বভৌম অধিকার। প্রতিটি জীবন অমূল্য— কোন কিছুর দ্বারা জীবনের মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। বিশ্বে এমন কোন অথরিটি নেই যেটি এই অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। এখন হত্যা করা কেন অপরাধ সেটা আমাদের বোঝা দরকার। একজন খুনীকে অপরাধী বিবেচনা করা হয় কেননা সে ব্যক্তির বেঁচের থাকা অধিকার হরণ করে। শুধু এই একটি অধিকার হরণ করার কারণেই সে অপরাধী হয়। যদি বিচারের মাধ্যমে খুনীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ন্যায্য হয়, তবে সেই একই অপরাধে— মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে ব্যক্তির বেঁচে থাকার অধিকার হরণের অপরাধে, আদালতকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া বিধেয় হয়। আরও একটা ব্যাপার খেয়াল করতে হবে যে আদালত, রাষ্ট্র বা কোন মহাক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি মহাবিশ্বে কোন জীবনের আগমণ ঘটায় না এবং তাদের কোন এখতিয়ারও নেই কোন জীবনকে মহাবিশ্বে থেকে বহিস্কার করার।

মৃত্যুদণ্ডের পক্ষপাতীরা মনে করেন যে কিছু সংকটময় পরিস্থিতিতে সমাজের ভালোর জন্য কোন খারাপ কাজও ভাল কাজে পরিণত হয়। সেই খারাপ কাজ করেই সমাজের ভালত্বকে রক্ষা করতে হয় অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই যুক্তির ফাঁকিটা হলো “অল্প কথায় কাজ হইলে বেশি কথার প্রয়োজন কী?” যদি মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে, খুনীকে আটকিয়ে রেখে বা অন্য কোন বিকল্প পন্থায় খুনীর আরও খুন করা থেকে সমাজকে রক্ষা করা যায়, তবে খুনীকে হত্যা করার বাড়াবাড়ি এবং তৎসংশ্লিষ্ট অন্যায় কী হেতু করা হবে?

মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে আরেকটা যুক্ততর্ক উপস্থাপন করা হয়— “যদি আপনার ভাইকে কেউ হত্যা করে তাহলে আপনি কি আপনার ভাইয়ের হত্যাকারীকে ছেড়ে দেবেন? আপনি কি চাইবেন না আপনার ভাইয়ের হত্যাকারীরও একই পরিণতি হোক?” এই বক্তব্য হেত্বাভাসযুক্ত (ফ্যালাসি)। এতে আশা করা হচ্ছে যে বিচার ব্যবস্থা ভিকটিমের পক্ষে অন্যায়কারীর প্রতি প্রতিশোধ নেবে, তাহলে ভিকটিম মানসিক শান্তি পাবে। বিচার ব্যবস্থাকে সকল পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ হতে হবে, কোনক্রমেই ভিকটিমের পক্ষালম্বন করতে পারে না। বিচার কোন প্রতিশোধ প্রক্রিয়া নয়। ‘জীবনের বিনিময়ে জীবন’, ‘চোখের বিনিময়ে চোখ’ কোন বিচার নয়, এটা প্রতিশোধ। ভিকটিমের পক্ষে প্রতিশোধ নেওয়া, বা ভিকটিমের প্রতিশোধপরায়ণতায় সহায়তা প্রদান এমনকি সমর্থনও ন্যায্য বিচার হতে পারে না। প্রতিশোধপরায়ণতা হিংসা এবং দ্বেষ থেকে উদ্ভুত একটা শক্তি প্রদর্শনের খেলা। প্রতিশোধ-ভিত্তিক কোন বিচার হিংসা এবং দ্বেষের দোষেই দুষ্ট হবে এবং এই বিচার সমাজের হিংসা, শক্তি প্রদর্শন, অসহিষ্ণুতা প্রতিপালনপূর্বক বজায় রাখবে। এই ধরণের বিচারকে আমি বলব প্রতিশোধভিত্তিক পাতানো-বিচার। একইভাবে শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে সংঘটিত বিচার প্রতিশোধপরায়ণ বিচার। বিচারের উদ্দেশ্য হতে হবে অন্যায়কারীকে সংশোধন করা, এবং সংশোধনের নিমিত্তে শাস্তি। শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে বিচার নয়। কিন্তু এমন শাস্তি, যেটি অন্যায়কারীকে সংশোধিত হওয়ার অধিকার ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে সেই শাস্তি অবৈধ এবং অন্যায় শাস্তি।

পত্রপত্রিকায় প্রায়শই ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’– এই শব্দবন্ধ চোখে পড়ে। কোন ঘটনায় ভিকটিম অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছে, কিংবা কোন জনপ্রতিনিধি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আমি মনে করি যে ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ আপত্তিকর ও অনৈতিক শব্দবন্ধ। কেবল মৃত্যুদণ্ড নয় কোন শাস্তিই দৃষ্টান্তমূলক হওয়া উচিত নয়। অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া বিচার আয়োজনের অন্যতম উদ্দেশ্য হিসাবে অনেকে চিহ্ণিত করেন। ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’র দৃষ্টান্ত স্থাপনের একটা বাসনা থাকে যে শাস্তির বীভৎসতা দেখে সমাজে ভীতিসৃষ্টি হবে এবং কোন লোক ওই একই অপরাধ করার সাহস পাবে না। মানে ঝিকে মেরে বৌকে শেখানোর মতো। কিন্তু সমাজের অপরাধ প্রবণতা কমানোর উদ্দেশ্যে একজন ব্যক্তিকে (সে যতই অপরাধী হোক) শাস্তি দেয়া হলে ওই ব্যক্তি স্রেফ স্কেপগোটে পরিণত হয়। অপরাধীকে শাস্তি যদি দিতেই হয়, তবে তা কেবল শাস্তি দেয়ার জন্যই দিতে হবে— দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য নয়, সমাজে অপরাধ কমানোর জন্যও নয়।

মৃত্যুদণ্ডের পক্ষালম্বনকারীগণ এই ‘দৃষ্টান্ত স্থাপনের’ যুক্তি দেন। তারা মনে করেন যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, যেমন কঠিন মৃত্যুদণ্ড, সমাজে হত্যার প্রবণতা কমাবে, লোকেরা হত্যা করতে ভয় পাবে, খুন করার আগে দুবার ভাববে যে খুন করলে তাকেও মারা যেতে হবে। এই চিন্তাও একইভাবে অনৈতিক হয়, কেননা একজনকে শাস্তি দিয়ে সমাজের অন্যায় কমার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। দুনিয়ায় ভবিষ্যতে ঘটবে এমন সম্ভাব্য অপরাধের দায় বর্তমানের খুনীর উপর চাপিয়ে তাকে মেরে ফেলার বৈধতা খোঁজা চুড়ান্তভাবে অনৈতিক। সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য কোন খুনীকে মেরে ফেলা যদি ন্যায্য হয় তাহলে অপরাধ প্রবণতা কমানোর জন্য কোন নির্দোষ ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়াও নৈতিক হবে (নির্দোষ ব্যক্তিকে স্কেপগোটে পরিণত করতে চোখে-ধুলা-দেওয়া আপাত-আইনসঙ্গত বিচারিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে যাতে সাধারণ জনতা মনে করে যে ওই লোকের মৃত্যদণ্ডই পাওনা ছিল)। যেহেতু, এভাবে একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে স্কেপগোট করে দৃষ্টান্তমূলক ভাবে মেরে ফেললে ‘হয়তো’ সমাজে দশটা সম্ভাব্য খুন হবে না।

তবে নৈতিকতার আলাপের বাইরে, দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য মৃত্যুদণ্ডের ভয় দেখিয়ে সমাজের অপরাধ প্রবণতা কমানোর যে দাবী, তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। গবেষণা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড হত্যাপ্রবণতা কমায় এমন কোন প্রমাণ নেই এবং বলছে যে মৃত্যুদণ্ডের ফল কারারুদ্ধ করার থেকে আলাদা কিছু নয়। বরং এর উল্টা নজিরও আছে যে মার্কিন দেশে যেসব প্রদেশে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদিত সেখানে হত্যাকান্ড বেশি। অবশ্য উপরের আলোচনাতেই বলেছি যে যদি মৃত্যুদণ্ডের দৃষ্টান্ত সমাজে হত্যাপ্রবণতা কমায়ও, তবু তা নৈতিক হয় না।

মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। মানুষের পরিচালিত বিচার ব্যবস্থাও ত্রুটিহীন নয়; অনৈশ্বরিক এই ব্যবস্থা সম্ভবত কখনও ত্রুটিহীন হবেও না। ফলত বিচার ব্যবস্থায় নির্দোষ ব্যক্তির সাজা পাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশে ভুল ব্যক্তিকে সাজা দেয়ার ভুরিভুরি নজির আছে। মার্কিন দেশে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ভুল প্রমাণিত হওয়ায় ১৯৭৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ১৪০ জন নির্দোষ ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে, যখন আমরা পরিপূর্ণ ত্রুটিহীন বিচারের নিশ্চয়তা দিতে পারি না, তখন অফেরত ও অসংশোধনযোগ্য কোন শাস্তি দেয়া ইনসাফহীন। ভুলের অধীনস্ত মানুষের যে কাজ সংশোধন করার ক্ষমতা নেই, সেই কাজ আইনি বিচার প্রক্রিয়ায় সম্পাদন করা বিচার ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে।

আমরা এখনও মানুষের সাইকোলজি সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না। আমরা জানি না যে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা আছে কিনা। যদি স্বাধীন ইচ্ছা না থাকে তাহলে খুনের জন্য একজন ব্যক্তিকে কতটা দায়ী করা যায়? যে পরিবেশ, পরিস্থিতি, সমাজ, সময়কাল, সিস্টেম, পরিবার, জিনেটিক বৈশিষ্ট্য, ঘটনাবলী এবং অন্যান্য নিয়ামকে একজন ব্যক্তি বেড়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে খুন করে, সেই একই পরিবেশ, পরিস্থিতি, সমাজ, সময়কাল, সিস্টেম, পরিবার, জিনেটিক বৈশিষ্ট্য, ঘটনাবলী এবং অন্যান্য নিয়ামক যদি একজন আদর্শ, সৎ, ফেরেশতাতুল্য ব্যক্তির বেড়ে ওঠায় পরিবেশন করা হয় তাহলে সেই ফেরেশতাতুল্য ব্যক্তিও কি পরবর্তীতে সেই একই খুনটা করবে? এই প্রশ্নের জবাব আমাদের কাছে নেই। হয়তো ফেরেশতাতুল্য ব্যক্তি তার পরাধীন ইচ্ছায় খুনটা করবে কিংবা হয়তো ফেরেশতাতুল্য ব্যক্তি তার স্বাধীন ইচ্ছায় খুনটা করবে না। স্বাধীন ইচ্ছা যদি না থাকে অর্থাৎ মানুষের ইচ্ছা কোন বাহ্যিক নিয়ামক দ্বারা যদি প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে ওই ফেরেশতাতুল্য ব্যক্তিকে তার করা খুনের জন্য আমরা তাকে কীভাবে দায়ী করবো? স্বাধীন ইচ্ছার বিষয়ে আমরা যেহেতু এখনও জানি না, এই না-জানা অবস্থাতেই মৃত্যুদণ্ড দিতে থাকা অন্যায়।

এই আলোচনায় মৃত্যুদণ্ডকে আমি কেবল নৈতিক দিক থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। মৃত্যুদণ্ডের উপযোগিতা-অনুপযোগিতা, মৃত্যুদণ্ডের ফলে সমাজ-রাষ্ট্রের লাভ-ক্ষতি নিয়ে বেশ কিছু স্টাডি আছে, সেগুলো আমার বিবেচ্য নয়। পৃথিবীতে ইতিমধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দেশ মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করেছে এবং যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ড আইনগত ভাবে চালু আছে তার অধিকাংশতেই মৃত্যুদণ্ডের চর্চা দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ আছে। আমি মনে করি যে একটি ন্যায় দুনিয়া তৈরি করার জন্য এই প্রাচীন প্রথা থেকে আমাদের যথাশীঘ্র বের হয়ে আসা উচিত।